২০২১ ...

অবশেষে বছর টা শেষ হলো শুরু হলো নতুন বছর। ২০২১ আমার জন্য খুব খারাপ একটা বছর হয়ে থাকবে। বছরের শুরুতে আব্বুর ব্লাড ক্যান্সার (AML) ধরা পরে. তারপর থেকেই সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। আব্বুকে নিয়ে হাসপাতাল ডাক্তার ইন্ডিয়া বাংলাদেশ করতে করতেই কিভাবে বছর টা পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। ক্যান্সার এর সাথে যুদ্ধ খুব কঠিন একটা যুদ্ধ। যারা এর মধ্যে দিয়ে গেছে তারাই শুধু জানে। মাত্র আট মাসের মাথায় নভেম্বর এর ১০ তারিখ, আব্বু চলে গেলো আমাদের ছেড়ে। যে যুদ্বে হেরে যেতে হবে জানতাম কিন্তু তা যে এতো কম সময়ে সেটা জানা ছিল না। বেঁচে থাকার জন্য আমার আব্বুর এই সংগ্রামের এই আট মাস আমরা সকলেই যে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম তা আমাকে অনেক কিছুই শেখালো। সব কিছু গুছিয়ে লেখাটাও যে বেশ কঠিন কাজ তা লিখতে গিয়ে বুঝেছি। আরো কয়েকবারই লেখার চেষ্টা করেছি কিন্তু বিক্ষিপ্ত ভাবনা গুলোকে আকার দেওয়াটা খুব একটা সহজ কাজ না। তারপরেও লেখার চেষ্টা করছি হয়তো অভিজ্ঞতা গুলো অনেকের কাজেও আসতে পারে। 


বছরের শুরুটা আব্বুর হালকা অসুস্থতা দিয়ে। আমার আব্বু শারীরিক ভাবে খুব ফিট একজন মানুষ ছিল।  ছোটো খাটো অসুস্থতা সে কোনোদিন কেয়ারই করতো না। উল্টো আমাদের বলতো তোমাদের একটুতে একটু হলেই ঠান্ডা লাগে আমার তো কিছুই হয় না। সেই তার হঠাৎ খুব কাশি হলো, সারেই না। বুকের মধ্যে খারাপ লাগা। হাটতে গেলে দুর্বল লাগা। এমনটা কখনো হয়নি। করোনার সময়, সবাই ভাবলাম করোনাই কিনা, টেস্ট করা হলো, নেগেটিভ। এই ডাক্তার সেই ডাক্তার এই টেস্ট সেই টেস্ট করে শেষে  ধারণা করা হলো হার্ট এর সমস্যা, যেহেতু আব্বুর আগে হার্টএ রিং পোড়ানো ছিল। ছোট কাকুর সাথে কথা বলে এনজিওগ্রাম এর জন্য রেডি হয়ে এভারকেয়ার হসপিটাল (আগের এপোলো) গেলাম। একেতো করণের প্রকোপ সাথে দেশ ব্যাপী লোকডাউন! কি যে একটা সময় গেছে তখন। এনজিওগ্রাম ঠিক আগ মুহূর্তে ব্লাড রিপোর্ট আসলো হিমোগ্লোবিন ৬ এর ঘরে যেখানে ১২ এর উপরে থাকাটা নরমাল। এর আগেও ৮ এর ঘরে ছিল তবে ডাক্তার ভেবেছিল অসুস্থতার কারণে কারণে কমছে, খাওয়াদাওয়া ঠিক হলে বেড়ে যাবে। তবে সপ্তাখানেকের ব্যবধানে এতো কমে যাওয়াটা অস্বাভাবিক বুঝেই ছোটো কাকুর ল্যাবেই ব্লাডের স্যাম্পল থেকে ক্যান্সার সেল এর টেস্ট করে ফেলে, সাথে বোনম্যারো টেস্ট এই কনফার্ম হয়ে যায় ব্লাড ক্যান্সার! মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া বলতে কি বোঝায় ঐদিনই প্রথম বুঝতে পারলাম। নিউজ টা যখন শুনলাম হঠাৎ করে সব ইন্দ্রিয় যেন কাজ করা বন্দ করে দিলো একসাথে। আমি আর কিছুই টের পাচ্ছিলম না, কে কি বলছে। এখন চিন্তা করতেই কষ্ট হয় তখন আব্বুর কেমন লেগেছিলো শুনে। তারপরেই শুরু হয়ে গেলো…বাকি দিন গুলো যে কিভাবে গেলো, রোলারকোস্টার রাইড এর মত। 


এপ্রিলের মাসে রোজা শুরুর ২ ৩ দিন পর এভারকেয়ার এর হেমাটোলজি ডিপার্টমেন্ট এর ডঃ সালেহ এর আন্ডারে ভর্তি হয়ে যায় আব্বু ১ মাস এর জন্য।শুরু হয় ইন্ডাকশন কেমো থেরাপি। টার্গেট ছিল রেমিশন বা ক্যান্সার সেল সব ধ্বংস করে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট এ যাওয়া। বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট প্রসিডিউর অনেক জটিল আর ব্যয়বহুল। তারপরেও আমরা চেষ্টা করবো বলেই ডিসিশন নিলাম। ১মাস পর দেখা গেলো রেমিশনে হয়নি। মানে ইন্ডাকশন কেমোর আশানুরূপ ইফেক্ট আসেনাই। এরপর ট্রিটমেন্ট চেঞ্জ করে টার্গেটেড থেরাপি শুরু হয়। এতে প্রতি মাসে ৭টা করে কেমো আর সাথে ওষুধ দিয়ে ট্রিটমেন্ট চলছিল। এই ট্রিটমেন্ট এ আমরা মোটামুটি সন্তুষ্টই ছিলাম আব্বুর অবস্থাও অনেকটা স্টেবল ছিল। যদিও চিকিৎসা ছিল খুবই ব্যয়বহুল। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির জন্য যা অনেকটাই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আব্বুর ব্যাংক এর সেভিংস আর আত্মীয় স্বজন সবার সহায়তায় চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলো। তারপরেও একটা অনিশ্চয়তা থেকেই যেত কত বছর এভাবে চালানো যাবে। চার মাস এই চিকিৎসা চলার পর বোনম্যারো টেস্ট এ খুব একটা ইম্প্রুভ হলো না। তখন ডাক্তার আবার বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট এর জন্য আবার হাই ডোজ কেমো শুরু করার কথা বলে। তখন সবার পরামর্শে আমরা ইন্ডিয়া (কলকাতা) টাটা মেডিকেল সেন্টার এ যাই, দ্বিতীয় ওপিনিয়ন এর জন্য। এই করোনা মহামারীর সময় বিদেশ ভ্রমণ এর অভিজ্ঞতা সাথে একজন ক্যান্সার রুগী নিয়ে, মোটেও সুখকর কিছু ছিল না। ছোট কাকু আমাদের সাথে ছিল দেখে অনেকটা সাহস পেয়েছিলাম ওই সময়। তবে টাটা মেডিকেল এর ডাক্তার ট্রিটমেন্ট সহ পুরো অভিজ্ঞতাটা টা বেশ ভালোই ছিল। ওখানকার ডাক্তার খুব আন্তরিকতার সাথে সব কিছু বুঝিয়ে বলল। তারা পরামর্শ দিলো যে আব্বুর বয়স আর রিস্ক সব মিলিয়ে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট এর দিকে যাওয়া টা ভালো হবে না বরং এভারকেয়ার এর দেওয়া টার্গেটেড কেমো থেরাপিটাই কন্টিনিউ করতে। তাতে ক্যান্সারটা যেহেতু কন্ট্রোলের মধ্যে আছে তাতেই আব্বু বরং ভালো থাকবে। অনেক রুগী নাকি এভাবেই ট্রিটমেন্ট চালিয়ে অনেক বছর ভালো ভাবেই আছে। আমরাও ডিসিশন নিয়ে নিলাম আর ট্রান্সপ্লান্টের দিকে না যাওয়ার। এর পর তারাই কেমোথেরাপি এর ওষুধপত্র কোথায় কিভাবে পাওয়া যাবে সব বলে দিলো। যেই কেমো ইঞ্জেক্সশন প্রতি পিস বাংলাদেশে ১২ হাজার টাকা করে নিতো সেইটাই ইন্ডিয়াতে মাত্র ২হাজার রুপিতে পেলাম। বুঝলাম কেন এতো মানুষ চিকিৎসার জন্য ইন্ডয়া যায়। ইন্ডিয়ার সুবিধা হলো সেখানে অনেক ক্যান্সার স্পেশালাইজড হাসপাতাল আর ওখানকার ডাক্তারাও ক্যান্সার এর মতো জটিল রোগ গুলোর ব্যাপারে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। আর ক্যান্সারের ওষুধও অনেকগুলো কোম্পানি প্রডিউস করে ফলে সবখানে পাওয়াও যায় দাম ও অনেক কম। ওই একই ওষুধ বাংলাদেশে ২ ১ জন আছে ইম্পোর্ট করে প্যাকেটে লেখা MRP এর উপর তিন ডবল টাকার স্টিকার দিয়ে এখানে বিক্রি করে। তাদের কাছে ছাড়া কোথাও তো পাওয়াই যায় না এমনকি আমি লাজ ফার্মার মতো দোকানেও খুঁজে পাইনি!


এই পর্যায়ে ডাক্তারদের কথামতো ট্রিটমেন্ট চলাকালে মনে হয়েছিল আব্বুর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বা অনেকটাই কন্ট্রোলের মধ্যে আছে। আর ইন্ডিয়া থেকে ট্রিটমেন্ট খরচটাও কিছুটা নাগালের মধ্য থাকায় ভেবেছিলাম এভাবে ট্রিটমেন্ট চালাতে পারলে আব্বু হয়তো আরো কয়েক বছর বেঁচে থাকবে আমাদের মধ্যে। আব্বু এই পুরো ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট, কেমোর ধকল, সব সত্ত্বেও শারীরিক ভাবে তেমন কোনো দুর্বলতাই প্রকাশ করে নি। হটাৎ কেউ দেখলে বুঝতেই পারতো না তার মধ্যে এতো বড় কোনো অসুখ আছে। নেক্সট ইন্ডিয়া ভিজিট এর ডেট ছিল এই জানুয়ারি মাসেই। আব্বু সেই সমস্ত প্রস্তুতিও নেওয়া শুরু করে দিয়েছিলো। বলেছিলো এবার সে একাই পারবে যেতে, সব তো চেনাই আছে। শুধু আম্মুকে নিয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হলো না। হঠাৎ করেই ইনফেকশন, আর সেই ইনফেকশন থেকেই মাত্র দুই দিনের মধ্যেই হস্পিটালাইজড। এমনিতেই ব্লাডের সমস্ত কাউন্ট কম থাকায় খুব দ্রুত ইনফেসকশন টা ছড়িয়ে পরে। যেখান থেকে আর রিকোভারি করতে পারলো না। এই ভয়টাই ডাক্তারদের ছিল। এই ধরণের রুগীর ক্ষেত্রে ইনফেকশন টা অনেক সিরিয়াস। খুব ছোট কোনো কারণেও ইনফেশন হলে তা আর সামলানো যায় না। হয়তো আমাদেরই কিছুটা নেগলেন্সিও ছিল। আব্বুও এতদিন পর আর খুব বেশি মেনে চলতে চাইতো না। সে সুস্থ থাকা কালে এতো একটিভ একজন মানুষ ছিল যে এই সময়ের রেস্ট্রিকশন গুলো তার কাছে অসুখের চেয়ে বেশি কষ্টের ছিল। প্রায়ই হয়তো বের হয়ে যেত বাইরে এটা ওটার ছুতোয়। বলতো এইভাবে শুয়ে বসে কিভাবে থাকা যায়। আসলে এমন আরো অনেক কিছুই বলা যায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের করার কিছুই থাকে না। মেনে নেওয়া যায় না তারপরেও জীবন জীবনের গতিতেই চলতে থাকে, একজনের না থাকার শুন্যতা টা বুকের এক পাশে চেপে রেখে। তবুও মাঝে মাঝে সেই শুন্যতা অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়। পৃথিবীটা ছায়াহীন লাগে। হঠাৎ কোনো প্রয়োজনে মনের অজান্তেই ফোনটা বের করে ফেলি আব্বুকে একটা ফোন দিলেই সব সমাধানের আসায়। 


আব্বু এমনিতেই সবার কাছেই খুব পছন্দনীয় মানুষ ছিল। যে যেখান থেকে আব্বুর খবর টা জেনেছে যেভাবে পেরেছে সহযোগিতার জন্যই এগিয়ে এসেছে, সে আর্থিক হোক বা মোরাল সাপোর্ট হোক, সবাই পাশে থেকেছে, সাহস জুগিয়েছে। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে আব্বুকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে সব মিলায় মনে হয় পঁচিশ ব্যাগের ও বেশি ব্লাড আরো দুই ব্যাগ প্লেটিলেট দেওয়া লেগেছে। জানি না ডাক্তার বলা মাত্রই কোথার থেকে কিভাবে সেই ব্লাড ম্যানেজ হয়ে গেছে। এমনকি ফেসবুকে পোস্ট দেখে একদম অপরিচিত কেউ এসে ব্লাড ডোনেট করে গেছে। পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষ আসলে ভালো, খারাপ মানুষের সংখ্যাই খুব কম। আব্বুর মুখেই শোনা কথা টার প্রতি আমার বিশ্বাস আরো বেড়ে গেছে এই কয়দিনে। সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আব্বু এতো পরিশ্রমী আর উদ্দমী একটা মানুষ ছিল তাকে কখনোই আমি বসে থাকতে দেখিনি। সারাজীবন দেখেছি সবার সব কাজে সবার আগে আব্বুর ডাক পড়তো, আব্বুও এগিয়ে যেতে। কোথাও অন্যায় কিছু দেখলে আর ঠিক থাকতে পারতো না। চট করেই আব্বু অনেক রেগে যেত আবার চট করেই তা পরেও যেত। ছোটবেলায় এই বিষয়টাকে অনেক ভয় পেতাম। শুধু আমি না আশে পাশের সবাই পেতো। বড় হয়ে বুঝেছি এই রাগের পেছনে আব্বুর মন কতটা নরম। একটা কথা আব্বু প্রায়ই বলতো কারো উপকার করতে না পারো কিন্তু কারো ক্ষতি হয় এমন কিছু কখনো করবে না। সারাজিবন সে সবার জন্যই করে গেছে। নিজের জন্য তেমন কিছুই করেনাই। বাবাদের জীবন টা বোধয় এমনই হয়। সারাক্ষন তার একটাই চিন্তা ছিল আমরা কিভাবে ভালো থাকবো। মহান আল্লাহর কাছে প্রাথণা করি, তিনি যেন আমার আব্বুকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।


Comments

Popular posts from this blog

সুর গহীনে

স্বপ্নবতা

ফেসবুক পরিচিতি