যখন আমি অ্যডিক্টেড ছিলাম!



নেশাটা ঠিক কিভাবে কবে থেকে শুরু মনে নেই। কিন্তু আমরা যারা নব্বইএর দশকে বড় হয়েছি গল্পের বই ছিল আমাদের বিনোদন এর অন্যতম মাধ্যম। বিশেষ করে মফস্বল শহরে যারা বড় হয়েছি তাদের জন্য তো বটেই। তখন টিভি বলতে বিটিভি, আর কম্পিউটার মোবাইল ইন্টারনেট তো ভবিষৎ এর জিনিষ। যতদুর মনে পড়ে একেবারে ছোট বেলায় রুশদেশের উপকথা নামে আমার একটা বই ছিল। যত দিন পড়া শিখি নাই আম্মুর কাছে শুনে শুনেই গল্প গুলো সব মুখস্ত ছিল। বেশ অনেক গুলো গল্প ছিল তাতে রাশিয়ান লেখকদের। এখন আর রাশিয়ার বই এদিকে মনেহয় না আসে। যাই হোক পড়া শেখার পর আরো কত বার যে বইটা পড়েছি হিসাব নেই। এত প্রিয় ছিল বইটা। রাশিয়ান পাবলিকশেন বলেই কিনা বইটা এত ভাল ছিল বাইন্ডিংস আার পেজ গুলো কত বছরেও একটুও নষ্ট হয়নি। এর পর আমর এক স্কুল টিচার বইটি নিয়ে যতসম্ভব সেও হরায় ফেলে। সেটা ক্লাস ওয়ান টু এর ঘটনা হবে। অনেক দু:খ পাইছিলাম বইটা হারায়। পরে অনেক খুজেছি কোথাও পাওয়া যায় না কিনতে। ক্লাস ওয়ান কি টু তে থাকতে একবার স্কুল থেকে কোন বার্ষিক প্রতিযোগিতা কিংবা রেজাল্টের জন্য বেশ কিছু বই পুরষ্কার পাই। সেই থেকে যত সম্ভব শুরু।

যাইহোক এর পর কোন ছোটদের পড়ার মত বই পেলেই সেটা পড়ে ফেলাটা রিতিমত অভ্যাসে পরিনত। জন্মদিনে আমার প্রিয় উপহার ছিল বই। ফাইভ সিক্স এ পড়ি তখন অনি (Tanvir Hassan) ছিল আমার বই পড়ার পার্টনার। আমরা সব সময় একসাথে ঘুরতাম ছোটবেলা থেকেই। আমাদের খালারা আমাদের নাম দিয়েছিল রাজার জামাই(গুপিগাইন বাঘাবাইন)। আমরা একই বই দুইজনই কখনওই কিনতাম না। (আমি অবস্য বই কিনতাম কম পড়তাম বেশি। আমার আব্বু এত গল্পের বই পড়া পছন্দ করত না। অনি অনেক বই কিনত ওর এই অভ্যাসটা এখনও আছে।) সৌমিক ভাইয়া( (Nur Arafat Shomik) (সোহান  তখন ছোট ছিল) অনেক বই পড়ত এবং ওদের বাসা ভর্তি ছিল গল্পের বই আর কমিক্স। ওদের বাড়িছিল আমাদের বড়মামার বাড়ির পাশে, একটু দুরে হওয়াই আমরা খুব একটা যাওয়ার সুযোগ পেতাম না। আম্মুদের সাথে মামা বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার মুল আকর্ষন ছিল সৌমিক ভাইয়ার বাসা। গেলেই নতুন কিছু বই আর কমিক্স নিয়ে চলে আসতাম। আমি আর অনি দুজন মিলে পড়ে পরের বার গেলে আগের গুলো দিয়ে আবার নতুন বই নিয়ে আসতাম।(যদিও এর মধ্যে অনেক বইই আর ফেরত দেওয়া হত না… সরি  ভাইয়া)। 

এর পর আরেকটু বড় হলাম বই এর পরিধি আর নেশা দুটোই আরো বাড়তে লাগল। দিনে একটা নতুন বই না থাকলে মনে হত কি করব আমি আজকে? আমার বন্ধু সার্কেলের যারা ছিল সবার সাথে একটা অলিখিত চুক্তি ছিল বই আদান প্রদান এর। কত জনকে যে আমি জোর করে বইয়ের নেশা ধরাইছি হিসাব নাই। লিপু ( A Rahman Lipu)হয়ত সবচেয়ে ভাল উধারন । ও তখন অনেক ছোটই। জোর করে কত বই ধরাই দিছি। কষ্টে মষ্টে পড়ছে বেচারা  তারপর এক সময় পুরোপুরি এডিকটেড, এখনও তাই আছে। তখন মাথায় একটা আইডিয়া আসল আমরা একটা লাইব্রেরি মত বানাইনা কেন? যেখানে সব সময় বই পাওয়া যাবে। আমি আর মাহিন(আরিফুল আলম মাহিন) মিলে তখন সত্যি সত্যি একটা ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি বানাই ফেলি। ক্লাস মনে হয় সেভেন এইট এ পড়ি তখন। (বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান লইব্রেরির বহু বছর আগেই আমরা এই কাজ করেছিলাম ভাবতে অবাকই লাগে) আমাদের লাইব্রেরি আইডিয়া টা ছিল খুবই সিম্পল যারা আমাদের সদস্য হবে সবার সংগ্রহের বই এর লিস্ট আমাদের কাছে থাকবে। সেই লিস্ট থেকে কেউ বই নিতে চাইলে তাকে সেই বই দেওয়া হবে। সদস্যদের বই দিয়েই লাইব্রেরি চলত।(যাদের সংগ্রেহে বেশি বই ছিল তারা ছিল আমাদের মোস্ট ভ্যালুএবল সদস্য) পরিচিত বড়, ছোট, বন্ধু, কাজিন সব মিলে বিশাল একটা বইয়ের ভান্ডার চলে আসল হাতে তাখন। মনে আছে তখন হাতে লিখে বইয়ের লিস্ট বানাইতাম। কার কাছে কার কোন বই আছে হিসাব রাখতাম। মাহিনের সাইকেলের পিছে বসে বই নিয়ে আমি আর মাহিন সদস্যদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বই দিতাম, নিতাম। উদ্দেশ্য ছিল একটাই বই পড়া। মাসিক ৫ না ১০ টাকা যেন চাদা নিতাম আরো নতুন বই কিনতে। কি একটা সময় গেছে তখন পুরাই গোল্ডেন টাইম। কত যে বই পড়ছি সে সময় হুমায়ুন থেকে সমরেশ…কিংবা জাফর ইকবাল থেকে সত্যজিত কি জুলভার্ন, সেবার তিন গোয়েন্দা মাসুদরানা ওয়েসার্ন তো ছিলই … এপাড় বাংলা, ওপাড় বাংলা, বিদেশি অনুবাদ কিছুই বাদ যেত না।

আমি একাডেমিক পড়াশোনায় ফাকিবাজ ছিলাম বরাবরই। কলেজে উঠলাম যখন কলেজে যেতে ইচ্ছা করত না। তখন বাসায় কম্পিউটার এসেছে। গেইম খেলতাম খুব। কলেজে হঠাৎ দেখলাম বন্ধুরা সবাই কেমন বড় হয়ে গেল। আমি আনইজি ফিল করতাম। যেতে ইচ্ছা করত না। ক্লাস ও খুব একটা হত না। বাসা থেকে বের হতাম খালার বাসায় বা অনির বাসায় গিয়ে বসে থাকতাম। শুয়ে শুয়ে বই পড়তাম। কলেজ টাইমে শেষ হলে বাসায় ফিরতাম। কিন্তু রোজ রোজ তো আর যাওয়া যায় না পরে বায়ায় জেনে যাবে। একদিন কি মনে করে কুষ্টিয়ার পাবলিক লাইব্রেরি গেলাম। গিয়ে দেখলাম এত বই মাথা ঘুরে গেল। সদস্য হয়ে গেলাম। সপ্তাহে দুইটা করে বই নেওয়া যেত। বাসায় তখন বই পড়া নিয়ে আব্বু খুব ঝামেলা করত। দেখতেই পারত না খুব রাগ করত (পড়ার বইয়ের নিচে গল্পের বই রেখে কত বার যে ধরা খাইছি)। তো লাইব্রেরি ফাকাই থাকত মানুষ জন খুব একটা থাকত না তাই যতক্ষন খুশি ওখানে থাকা যেত আর যত খুশি বই নিয়ে পড়া যেত। রোজ গিয়ে এক কোনে একটা টেবিলে বসে বই পড়তাম কলেজ টাইমে। এইচ,এস,সিতে রেজাল্ট বাসার সবার আশানারুপ না হওয়ার পেছনে কারন ছিল দুইটা এক বই, দুইকম্পিউটার (বই পড়েই কম্পিউটারে প্রোগ্রাম আর ইলেক্ট্রনিক্সের ভুতও চাপে মাথায়। ভিবি আর ফটোসপ, রেজিস্টার, ট্রানজিস্টার, সোলডারিং আয়রন এইসব ছিল আমার পাস টাইম)। (সবার আশানারুপ রেজাল্ট বললাম কারন আমার দিক দিয়ে রেজাল্ট যাই ছিল পুরাই আশাতিত । আমি যে পাশ করছিনা এই বিষয়ে আমার কোন রকম সন্দেহই ছিল না রেজাল্ট এর আগে। কারন কলেজের পুরো দুই বছর ফাকি দিয়ে টেস্ট এর পরের ৩ মাস একটু পড়ার ট্রাই করছিলাম। এস,এস,সিতে ও একই কাজ করে ধারনা ছিল লাস্ট ৩মাস পড়লেই তো হয়। কিন্তু এবার পড়তে গিয়ে দেখি পুরাই অথই সাগর-১,২ কোন কুল কিনারা নাই)

যা হোক এরপর ঢাকায় চলে আসি। বড় চাচার বাসায় থাকতাম তখনও এআইইউবিতে ভর্তি হইনি। বড় চাচার ছেলে মেয়ে সবাই বিয়েথা করে বাইরে সেটেল্ড। বাসায় একা একা ভাল লাগত না কিছু চিনতাম ও না যে কোথাও যাব। সারা দিন বাসার মধ্যেই এদিক সেদিক ঘুরতাম।হঠাৎ একদিন চাচির রুগি দেখার চেম্বার রুমে আবিষ্কার করলাম বড় এক সেলফ ভর্তি বই। বুঝলাম আমার কাজিনরাও ভালই বই পড়ত। (তারা আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় হওয়ায় তত টা ক্লোজ ছিলনা) তখন থেকে আমার ঢাকায় থাকা একটু সহজতর হয়ে গেল। এর মধ্যে আরেক নেশাখোরের খোজ পাইলাম রাইয়ান (Ryan Mansur)। সো বন্ধুত্ব হইতে সময় লাগে নাই। এর পর বই পড়ার পরিমান বাধ্য হয়েই কমায় দিতে হয় এআইইউবি তে ভর্তি হয়ে। তারপরেও সাজ্জাদ(Skimo Hosaain) আর সাইফুল্লারে (Mohammad Saef Ullah Miah)পাই যারা বইয়ের কদর বুঝত। ওদের সাথেও বই দেওয়া নেওয়া করছি অনেক। ইন্টারনেট এর কল্যানে পিডিএফ বই, ব্লগ আর পড়ার মাধ্যমটাও আরো অনেক বড় হয়ে যায়।এখন ফেসবুক এর যুগে বই পড়ার সময় কই মানুষের। ফেসবুকই পড়ে সারাদিন ধরে। তারপর আবার বই এর যায়গা টা অনেকটাই দখলে হলিউডের মুভি আর সিরিজ গুলোর। তারপরও একটা বই পড়ার যে শান্তি সেটা কিছু দিয়েই পোষায় না, বইখোর ছাড়া কেউ বুঝবে না এটা। এখনও নতুন বই পেলেই সময় করে পড়ি। প্রতি বছর বইমেলা যাই বই কিনি। হুমায়ুন আহম্মেদ আমার সবচেয়েপ্রিয় লেখক হওয়ায় একটু অসহায় ফিল হয় যখন দেখি নতুন কোন বই নাই তার। ছোট বেলায় পড়া পুরান বই গুলো আবার পড়ি সময় পেলে। কিন্তু সেই দিনগুলো খুব মিস করি যখন আমি সত্যিই অ্যডিক্টেড ছিলাম।

Comments

Popular posts from this blog

সুর গহীনে

স্বপ্নবতা

ফেসবুক পরিচিতি