প্রোগ্রামারের স্বপ্ন (গল্প)


[প্রিয় হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিনে তাঁকে উত্সর্গ করে করে একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। গল্প টা মাথায় ছিল কিন্তু লিখতে লিখতে দেরি হয়ে গেল কি আর করা। গল্প টা অবস্যই তার লেখা থেকেই অনুপ্রাণিত...ক্ষুদ্র প্রয়াস।]


আমাকে একটা ইন্টার্ন ছেলে দেওয়া হয়েছে। ছেলেটার নাম সফিক। বেশ সার্প একটা ছেলে। প্রোগ্রামিং এর মাথা ভাল। সহযেই একটা প্রবলেম ধরতে পারে। বেশ অবিডিয়েন্টও। কোন কাজ দিলে খুব উৎসাহের সাথে করে দেয়। কন্টেস্ট করত স্টুডেন্ট থাকাকালে। কন্টেস্টএর ছেলে মেয়েগুলো কে এই জন্যই আমার ভালো লাগে। কোডিং এদের কাছে নেশার মত। কাজ মনেই করে না। তাই এরা ভাল ও করে অন্যদের তুলনায়। তবে একটা প্রবলেম আছে তা হল প্রোগরামিং যে শেষ পর্যন্ত একটা প্রোডাক্ট আর প্রোডাক্ট মানেই বিজনেস এইটা বুঝতে এদের অনেক দিন লেগে যায়। যাই হোক, একটা নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছি একটু জটিল বিষয় টা কয়েকটা প্লাটফর্মে এক সাথে। বেশ চ্যালেন্জিং। টিমের সবাই অনেক এক্সাইটেড। সফিক সবচেয়ে বেশি। এটাই ওর প্রথম কোন সত্যিকারের কাজ, হওয়াটাই সাভাবিক। মনে আছে আমিও প্রথম কাজটা নিয়ে কতটা এক্সাইটেড ছিলাম।

সেদিন বিকালে একটা প্রবলেম নিয়ে বসে আছি, ভাল যন্ত্রনা দিচ্ছে। ভেবেছিলাম আজকে একটু আগে বের হব তা আর হল না। এমন সময় সফিক এসে ডাকল,

ভাইয়া আজকে যতটুকু কাজ করছি দিয়ে যাই অবজেক্ট গুলা?

আমি বললাম একবারে দিও পুরাটা শেষ করে।

না ভাইয়া নিয়ে রাখেন নাইলে ঝামেলা হয়।

আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম কিসের ঝামেলা কিসের?

না মানে … যদি হারায় যায় বা কিছু হয় তাই।

আমি বুঝলাম, এই ভয় টা আমিও পাই মাঝে মাঝে। কত বার যে একই কোড আবার লেখা লাগছে আমার। ওকে দিয়ে যাও। বললাম আমি।

সফিক পেনড্রাইভ এগিয়ে দিল। আমি কপি করে ফেরত দিলাম ড্রাইভ টা। পেনড্রাইভ হাতে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকল। আমি বললাম কি কিছু বলবা?

না মানে একটা বিষয় নিয়ে আপনার সাথে একটু ডিসকাস করতাম।

কি বিষয়? একটু বিরক্ত হচ্ছি এবার। এমনি মন পড়ে আছে কোডিং এ। তারপরও আমার অভিজ্ঞতা বলে নতুন জয়েন করা ছেলেমেয়ে গুলার ডিস্কাসন মানেই তাদের চাকরি, কেমন করছে, কবে পার্মানেন্ট হবে, স্যালারি কেমন পাবে, একটু তেল দেওয়া ইত্যাদি।

সে বলল ভাই কয়দিন ধরে একটা সমস্যায় পড়ছি। এইয়ে আপনাকে অবজেক্ট গুলা দিলাম না? তার একটা কারন আছে।

আমি বললাম হা বললে তো যদি কিছু হয় অবজেক্টগুলার।

সে বলল আমি জানি হবে।

মানে? কি জান?

মানে ভাইয়া আমার কোড প্রতিরাতে একটা মেয়ে এডিড করে দেয়।

আমি এবার ভুরু কুচকে তাকাই? জিগেস করি কি বললে?

একটা মেয়ে।

মেয়ে টা কে? তোমার গার্লফ্রেন্ড?

না ভাই আমার গার্লফ্রেন্ড নাই। চিনি না।

তাহলে? সে তোমার কোড পায় কোথায়? আর তুমিই বা তাকে দাও কেন এডিড করতে?

সে বলে ভাইয়া কাউকে বলেন না হ্যা? সেই মেয়েটা স্বপ্নে আসে।

স্বপ্নে?! স্বপ্নে এসে তোমার কোড এডিট করে?

হ্যা। তারপর আমি সকালে পিসি অন করে দেখি সব এডিড করা। বসে বসে আবার সব ঠিক করতে হয়।

তুমি কি আমার সাথে ইয়ারকি করছ? আমি বিরক্তির চরম পর্যায়।

সে বলে না ভাই বিশ্বাস করেন। কাউকে বলতে পারছিলাম না বিষয় টা তাই আপনাকে বললাম।

খুব ভাল করছ। আর কাউকে বলোও না। ওকে? যাও এবার।

ওকে ভাই। বলে মাথা নিচু করে চলে গেল সে।

আমি মনে মনে বললাম গেছে পোলার মাথাটা পুরাই।


এরপর সপ্তাখানেক খুব ব্যাস্ত সময় কাটল। সফিকের কথা ভুলেই গেলাম। সব মডিউল গুলো গুছিয়ে আসছে প্রায়। পুরোটা একবার কম্পাইল দিলাম। হল না। কম্পাইল এরর। ব্যাপার কি চেক করতে গিয়ে দেখি সফিকের একটা মডিউল থেকে এরর আসছে। ডাকলাম ওকে। দিলাম একটা ঝাড়ি কম্পাইল না করে অবজেক্ট দিছ কেন?

সে কাচুমাচু স্বরে বলল কই ভাইয়া আমি তো কম্পাইল করেই দেই সব কোড। দেখনা তো কোথায় এরর।

আমি দেখালাম। সে বলল ও গতকাল কাল ভুল করে আগের ফাইল টা দিয়ে দিছি। সফিক রোজ যাওয়ার আগে তার অবজেক্ট গুলো দিয়ে যায়। আমি বললাম দেখবা না খেয়াল করে কি দিচ্ছ? ওকে যাও ঠিক ফাইল টা নিয়ে আস।

সে এনেদিল। আমি কপি করে কম্পাইল দিলাম। সফিক পাশে দাড়িয়ে। আমি বললাম সফিক তোমার স্বপ্নের মেয়ে কি এখন জালাচ্ছে।

না ভাইয়া জালায় না তো সে। আমি বললাম তো কি করে?

হেল্প করে।

হেল্প করে? কিভাবে? ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।

জি ভাইয়া ও প্রবলেম সল্ভ করে দিয়ে যায় আমার।

আমি বললাম ও আচ্ছা।

তার মানে রোজ রাতে তুমি স্বপ্নে দেখ একটা মেয়ে তোমার পিসিতে বসে তোমার কোড লিখে দিচ্ছে? আর তোমার সব কোড লেখা হয়ে যায়? ভাল তো। আমি হাসতে হাসতে বললাম।

সে বলে না ভাইয়া বিষয়টা তেমন না। সে আমার সাথে অনেক গল্প করে। আমি কোন প্রবলেম নিয়ে কাজ করছি বলি তখন সে বলে কি করে সল্ভ করতে হবে। লিখেও দেয় মাঝে মাঝে। পুরা কোড না সুডো কোড আরকি। আপনি আগের ফাইলটা ওপেন করেন দেখাই।

আমি ওপেন করলাম দেখলাম সুডো কোড টাইপের কিছু আছে ওর সোর্সকোডে। আমি বললাম তুমি বলছ এইটা একটা মেয়ে তোমার স্বপনে এসে লিখে গেছে?

হ্যা।

সফিক তুমি তো বুদ্ধিমান ছেলে নিশ্চই বুঝছ তুমি যেটা বলছ এইটা একটা ইমপসিবল ব্যাপার। স্বপ্নে তুমি কিছু দেখতেই পার খুবি সাভাবিক। এই বয়সে স্বপ্নে কোন মেয়েকে দেখতেই পার। সে তোমার কোড করে দিচ্ছে এইটাও দেখতে পার যেহেতু তুমি এখন এইটা নিয়ে খুব বিজি। সবসময় প্রবলেম নিয়ে চিন্তা করছ সো আমি ধরে নিচ্ছি সভাবিক বিষয় টা। কিন্তু অসাভাবিক টা হল বলছ সেই কোড লেখা হয়ে যাচ্ছে তোমার পিসি তে!

হ্যা আমি কসম করে বলছি ভাইয়া এই কোড আমি লেখিনাই। কিন্তু এইটা দেখে আইডিয়া পাইছি কিভাবে সল্ভ করতে হবে প্রবলেম টা। সেইভাবেই করছি সল্ভ ও হইছে। কিন্তু আমি ভয় পাই যদি কোন দিন দেখি মেয়ে টা আমার সব কোড ডিলিট করে দিছে বা আগের কোডে কোন কিছু করছ তখন সব যাবে তাই রোজ আপনার কাছে ব্যাকাপ রেখে যাই।

আমি বললাম বুঝেছি। কিন্তু এইটা কিভাবে সম্ভব?

ভাই আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? ডাক্তার দেখাব?


আমি বললাম, না আগেই যাওয়া দরকার নাই। ডাক্তারের কাছে গেলেই এক গাদা ঘুমের ঔষুধ ধরায় দিবে। খেয়ে সারাদিন ঝিমাবা। প্রবলেম টা কি আগে বোঝার চেষ্টা করি হ্যা। আচ্ছা তুমি বললে মেয়েটার সাথে গল্প কর কি গল্প?

মনে থাকে না ভাইয়া। কিন্তু এইটা মনে হয় অনেক ভাল লাগে তখন।

মেয়েটা দেখতে কেমন?

উম…চেহারাও মনে থাকেনা। কিন্তু জানি অনেক সুন্দর। কিছুক্ষন চিন্তাকরে উত্তর দিল।

হুম। ঠিকই আছে, স্বপ্ন হল সর্ট টার্ম মেমরি। ঘুম ভাঙার কিছু সময়ের মধ্যেই মুছে যায়। আস লজিকালি চিন্তা করি বিষয়টা নিয়ে, তুমি কয়দিন এই প্রজেক্ট টা নিয়ে অনেক এক্সাইটেড। সবসময় ভাবছ প্রবেমগুলো নিয়ে। ঘুমাতে যেয়েও ভাবছ কিভাবে সল্ভ করবা।

হুম।

ফলে ঘুমের ভেতরেও তোমার মস্তিষ্ক প্রবলেম টা নিয়ে চিন্তা করছে। একসময় একটা সলিউশনও বের করছে। কিন্তু ঘুমথেকে ওঠার পর সেইটা আর মনে থাকছে না তোমার। তাই আবার চিন্তা করে সলিউশন টা বের করা লাগছে তোমার। কিন্তু তোমার সাবকন্সাস মাইন্ড বিষয় টা চাচ্ছে না এমন হোক। তাই সে একটা গল্প তৈরি করছে একটা মেয়েকে নিয়ে যেটা স্বপ্নে দেখছ তুমি। আমার ব্যখ্যাটা পছন্দ হয়েছে?

হ্যা ভাল ব্যাখ্যা। কিন্তু কোডে এডিড হয়ে যাওয়া টা?

এইটার ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে বল তুমি ঘুমানোর সময় কি ল্যপটপ পাশে রেখে ঘুমাও?

হ্যা। শুয়ে কিছুক্ষন ফেসবুক করি। এরপর ঘুম পেলে ল্যাপটপ পাশে রেখে ঘুমিয়ে যাই।

হুম আমিও তাই ভাবছিলাম। আমার মনেহয় কোডিং পার্ট টা তুমি নিজেই কর। ঘুমের মদ্ধেই। জানো তো অনেকে ঘুমের মধ্যে হাটা হাটির অভ্যাস থাকে?

হ্যা। আর আমি করি কোডিং? হায়রে কি হবে আমার? কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল সফিক।

এক কাজ কর। আজকে ল্যাপটপ অফিসে রেখে যাও। দেখ কি হয়।

আচ্ছা। কিন্তু ফেসবুক? স্যড ফেসে বলে সফিক।

আমি বললাম আরে একদিন ফেসবুক না করলে মারা যাবা না। আর লাগলে মোবাইল আছে না?

ওকে। দেখি কি হয় বলে চলে গেল সে।


পরদিন সকালে অফিসে ঢুকতেই সফিক দৌরাতে দৌরাতে এল। বলল ভাই কালকে কোন স্বপ্নই দেখিনাই। আরামে ঘুম দিছি।

আমি বললাম গুড। তাহলে তো হইলই। কয়েকদিন ল্যাপটপ অফিসেই রেখে যাও। আমার মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে। আর তোমার প্রবলেম সল্ভ করার জন্য কোন স্বপ্নের মেয়ের দরকার নাই জানি আমি। বললাম হাসতে হাসতে।

ও বলল জি ভাইয়া। ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

আরে ধন্যবাদের কিছু নাই। মন দিয়ে কাজ কর ডেডলাইন সামনে।



এর কিছুদিন পর বের হব অফিস থেকে এমন সময় সফিক ডাকল ভাইয়া একটু শুনবেন? আমি বললাম কি?

বলে ভাইয়া ল্যাপটপ টা নিয়ে যাব আজকে?

আমি বললাম যাও প্রবলেম কি?

সে বলে না মানে আপনি যে নিষেধ করছিলেন।

হ্যা সে তো তোমার জন্যই করলাম। এখন আর সমস্যা নাই তো?

না। আর দেখিনা এখন।

আমি বললাম গুড।

সফিক মাথা নিচু করে বলল কিন্তু মেয়েটাকে আবার দেখতে মন চায়।

এই জন্য নিতে চাও ল্যাপটপ?

সফিক লাজুক ভঙ্গিতে মাথা ঝাকালো।

আমি মনে মনে বললাম মেয়ে মানুষ, বড়ই খারাপ জিনিষ, সে বাস্তবেই হোক আর স্বপ্নেই হোক।

Comments

Popular posts from this blog

সুর গহীনে

স্বপ্নবতা

ফেসবুক পরিচিতি